
বাংলাদেশের ইতিহাসের কিংবদন্তীতুল্য আইনজীবী, জাতির অভিভাবক খ্যাত ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ (১২ জুলাই)। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বাংলাদেশের সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। তার বড় সন্তান বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচিতি
শিক্ষাজীবন
কর্মজীবন
ইশতিয়াক আহমেদ ছাত্রজীবনে মুকুল ফৌজ ও ব্রতচারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৬ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি-র দুজন অফিসারকে ভারত সরকার কর্তৃক কঠোর শাস্তি দানের প্রতিবাদে তিনি কলকাতায় বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ র্যালিতে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় তিনি গ্রেপ্তার ও অন্তরীণ হন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি দুইবার কারারুদ্ধ হন। তিনি ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ছাত্রসভা বন্ধ করার প্রতিবাদ কমিটি সংগঠনে অংশ নেন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে গর্ভনর জেনারেলের শাসন প্রবর্তনের বিরোধিতা করার জন্য তৃতীয়বার কারারুদ্ধ হন তিনি।
১৯৬০ সাল থেকে সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ আমৃত্যু আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শাস্ত্রের খণ্ডকালীন অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৭২-১৯৯১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের আইন উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল এবং ১৯৭৬ সালে এটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন।
বাবার সঙ্গে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত / ফাইল ছবি
সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ দুইবার (১৯৭৮-১৯৭৯, ১৯৮৯-১৯৯০) সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং দুইবার (১৯৭৯-১৯৮২, ১৯৮৯-১৯৯২) বার কাউন্সিলের অর্থনৈতিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৮৭৭ সালে তাকে কোম্পানি আইন সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়। ১৯৮১ সালে তার প্রণীত প্রতিবেদনে ১৯১৩ সালের কোম্পানি আইনের তাৎপর্য্যপূর্ণ রদবদলের প্রস্তাব পেশ করা হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল’ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স-এর সক্রিয় সদস্য হিসেবে তিনি ১৯৮৫-১৯৯১ সালে বিকল্প চেয়ারম্যান ছিলেন এবং ১৯৯২ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাষ্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ও চেয়ারম্যান ছিলেন।
সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ বহু আর্ন্তজাতিক আইন সম্মেলন ও সেমিনারে যোগ দিয়েছেন। তিনি ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক গ্রুপের সদস্য হিসেবে তিনি শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপের জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন।
সুদীর্ঘ চার দশকের আইন পেশায় তিনি বিশেষত সিভিল আইনের বিশিষ্ট আইনজীবী ও নেতৃস্থানীয় সংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। বিবিধ আইনের অন্তর্নিহিত পান্ডিত্যপূর্ণ বিশ্লেষণ বিশেষ করে সংবিধানের জটিল তত্ত্ব ও কঠোরতম ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য তাকে সুপ্রিম কোর্ট ‘অ্যামিক্যাস কিউরি’ নামে অভিহিত করে। তিনি যে সব নামকরা মামলায় তার পেশাগত উৎকৃষ্টতার প্রমাণ রেখেছেন, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আনোয়ার হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলা, যেটি ৮ম সংশোধনী মামলা নামে পরিচিত। ৮ম সংশোধনী দ্বারা দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি বিভাগীয় বেঞ্চ সৃষ্টি করে আদালতের অখণ্ডতাকে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের নেতৃত্বে আইনজীবীরা অবিরাম আন্দোলন চালিয়ে ১৯৮৯ সালে এই সংশোধনী বাতিল করতে সক্ষম হন।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সপক্ষে তার সুতীক্ষ্ণ যুক্তির ভিত্তিতে ১৯৯০ এবং ১৯৯৬ সালে সাপ্তাহিক যায় যায় দিন, ১৯৯০ সালে সাপ্তাহিক রোববার, সাপ্তাহিক খবরের কাগজ এবং দৈনিক মানব জমিন প্রকাশ বন্ধ সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশের বিরুদ্ধে আদালত রায় দেন।
সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পক্ষাবলম্বন করার জন্য জনগণের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বক্তব্য ও সক্রিয় সংগ্রামের জন্য তিনি ১৯৮৩ এবং পুনরায় ১৯৮৭ সালে কারাভোগ করেন।
১৯৯১ সালে নির্বাচিত সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর ইশতিয়াক আহমেদ রাষ্ট্রপতি শাসনের স্থলে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে পার্লামেন্টারি শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারনা এবং এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সাপ্তাহিক যায় যায় দিন তাকে ১৯৯৫ সালে ‘ডেমোক্রাসি অ্যাওয়ার্ড’ স্বর্ণপদকে ভূষিত করে।
১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ২০০১ সালে তিনি দ্বিতীয়বার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তার উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল সংবিধান মোতাবেক নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করার কাজে উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
আইন পেশায় ব্যস্ততা সত্ত্বেও সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তিনি ঢাকা নর্থ রোটারি ক্লাবের সভাপতি (১৯৭০-১৯৭১), বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ও বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের আজীবন সদস্য, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-এর বোর্ড অব ট্রাষ্টির সদস্য এবং অনুরূপ বহু সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন
সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ১৯৫৫ সালের জুনে সুফিয়া আহমেদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সুফিয়া আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশের প্রথম নারী জাতীয় অধ্যাপক। ২০২০ সালে অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ মারা যান। তাদের দুই সন্তান; ছেলে বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধন বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কন্যা রাইনা আহমেদ পেশায় একজন চিকিৎসক।
২০০৩ সালের ১২ জুলাই পরলোকগমন করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ।